টেলিভিশন জনসংযোগ বিভাগে সফল কয়েকজন(http://www.ittefaq.com.bd/admin/news_images/2013/01/10/thumbnails/image_10112.jpg)
একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রথমে একজন সাংবাদিক, লেখক, ফিচার লেখক এবং পরবর্তীতে সে একজন তথ্যব্যাংক, যে ব্যাংক থেকে মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত ব্যবসা ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংবাদ ডিজাইন এবং মিডিয়ার মাস্টার প্ল্যান ইত্যাদি সংগ্রহ করে থাকে। পিআরও প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ভিআইপি, সিআইপি কিংবা মিডিয়ার সম্পাদক, বাণিজ্যিক ম্যানেজার, সংবাদকর্মীদের সাথে কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে প্রথমেই তাকে নিজস্ব ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় অবশ্যই লিখিত, মৌখিক উভয়দিকেই অভিজ্ঞ হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষের আস্থা বাড়াতে এই সেকশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই সেকশনকে ঊর্ধ্বতনদের সাথে আলোচনা ও যোগাযোগের প্রেক্ষিতে মার্কেটিংয়ের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি তথা অফারের ক্ষেত্রে সজাগ থাকতে হবে। যখন যে অফার প্রতিষ্ঠান করবে তা সততার সাথে রক্ষা করার প্রতি আপোষহীন থাকতে হবে। কাজেই টেলিভিশন জনসংযোগ পেশাটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। জনসংযোগ পেশায় বাংলাদেশের টেলিভিশন মিডিয়ার কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সাক্ষাত্কারের মাধ্যমে এই পেশার কথা তুলে ধরা হলো আজকের এই ফিচারে। সাক্ষাত্কারগুলো নিয়েছেন রবি হাসান।
হাবিবুল হুদা পিটু
আপনার হাত ধরেই এ দেশে টেলিভিশন পিআর শুরু। এর প্রথম দিককার ঘটনা বলুন।
- শুরুতে এদেশে একটি মাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল, বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেটির জন্ম ১৯৬৪ সালে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যা হয়, দায়সারা গোছের অনুষ্ঠানক্রমের একটি পাক্ষিক/মাসিক কাগজ পেত তখনকার পত্রিকাগুলো। এ ভাবেই চলেছে দীর্ঘদিন। তখনকার একটি পত্রিকা এই ধারাকে ভেঙে দেয়। তারা নির্ভুল পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন সূচিপত্র প্রকাশ করে এবং এটি বেশ জনপ্রিয়ও হয়। কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব শাইখ সিরাজ সাহেব এই পত্রিকাটিতে সরবরাহ করতেন, যেটির নেপথ্যে ছিলেন আরেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর। নিজেদের দায় থেকেই পত্রিকাটি কাজটি করে যা পাঠক-দর্শকদের মনে এক ধরনের জাগরণ তৈরি করেন। ১৯৯৬ সালের মধ্যভাগে যখন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম একটি সৃজনশীল প্রোডাকশন হাউজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন থেকেই এর অন্যতম কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর তাদের সৃজনশীল প্রোডাকশনগুলোর প্রচারের জন্য ভাবতেন। টেলিভিশনে যাওয়ার আগে দর্শকরা প্রোডাকশনটি সম্পর্কে জানুক এটি তিনি চাইতেন। ১৯৯৭-এর এপ্রিলের শেষভাগে আমি আজকের পত্রিকার চাকরিতে ইস্তেফা দেই। সেদিনই সাগর ভাই আমাকে ডেকে নেন। সাগর ভাইয়ের সঙ্গে আমি পূর্বপরিচিত ছিলাম। তিনি আমাকে ডেকে একটি দায়িত্ব নিতে বলেন। সাংবাদিকতার সুবাদে আমি হয়তো নিউজটি লিখতে পারব, কিন্তু আমি তো কাউকে চিনি না এগুলো প্রকাশ হবে কীভাবে? এমন দুশ্চিন্তার আসান করে দিলেন তিনি। নিজের পরিচিতজনদের নাম বলে আমাকে পত্রিকাগুলোতে পাঠানো শুরু করলেন।
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের যে সব প্রোডাকশন হয়, তার প্রায় সবগুলোর সংবাদ লিখে, ছবি জোগাড় করে পত্রিকা পত্রিকায় পৌঁছে দেই। শুরুতে কাজটি কঠিন লাগলেও কিছুদিনের মধ্যে দেখলাম পত্রিকা থেকেই এর আগ্রহটা বেড়েছে। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার একটি সখ্যতা হয়ে গেল।
এটিএন বাংলার আত্মপ্রকাশের পর আমার কাজটি বেড়ে গেল। কারণ আমাদের হাউজ থেকে এটিএন বাংলার অনেক অনুষ্ঠানের কাজ করতে হতো। শুরুতে বিটিভি, পরে এটিএন বাংলা, আমাদের হাউজের প্রায় সব অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ পাঠানো হতো পত্রিকায়।
টিভি পিআর আমাদের বিনোদন ইন্ডাজট্রিতে কতটুকু ভূমিকা রাখে?
সে সময় একটি মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, পত্রিকাগুলোতে টিভি বিনোদনের সংবাদ বেশ ভালোভাবে ছাপা হচ্ছে। যা পাঠানো হতো তার প্রায় কোনো কিছুই বাদ যেত না। পত্রিকার পাতায় জায়গা বাড়তে লাগল। ব্যাপারটি অন্য প্রোডাকশন হাউজগুলোকেও নাড়া দিলো। পরে ১৯৯৯ সালে ১ অক্টোবর চ্যানেল আইয়ের জন্ম হলে এর প্রচার প্রচারণার ব্যাপকতা নিয়ে কাজ শুরু করি। চ্যানেল আইয়ের এ সাফল্য দেখে এটিএন বাংলাও তাদের নিজস্ব একজনকে নিয়োগ দিল এই কাজের জন্য।
ওমর ফারুক
একজন পিআরও একটি চানেলের ইমেজ তৈরিতে কতটুকু ভুমিকা রাখে?
আসলে দেখুন, বর্তমান সময়টাই এমন যে কী করছেন তা মানুষকে জানাতে পারছেন কি না? যদিও একটি টিভি চ্যানেল চাইলেই নিজের প্রমোশন করতে পারে, কিন্তু সেটা শুধু টিভি দর্শকদের মাঝেই। কিন্তু একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা একটি চ্যানেলের প্রমোশন ছড়িয়ে দেন সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মাঝে। আর চ্যানেলের জনসংযোগ কর্মকর্তা চ্যানেলের প্রমোশনাল করেন দৈনিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে। শুধু টেলিভিশনের ইমেজই নয়। আমাদের বিনোদন ও কর্পোরেট ইন্ডাস্ট্রিতেও টিভি জনসংযোগ কর্মকর্তাদের ভূমিকা কম নয়।
এই পেশায় কীভাবে এলেন?
পাবলিক রিলেশনকে যে পেশা হিসেবে নেব, এটা ভাবিনি কখনও। ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হওয়ার। সাংবাদিকতাও করেছি বেশ কয়েক বছর। গ্রামের বাড়িতে যখন ছিলাম তখন একটি জাতিয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। এরপর ঢাকায় আসার পর কাজ করেছি কয়েকটি দৈনিকের ফিচার বিভাগে। হঠাত্ করেই একদিন ডাক এলো আরটিভি থেকে। কথাবার্তা বললাম দেখলাম জনসংযোগ আসলে সাংবাদিকতাই। যোগদিলাম নতুন পেশায়। তার ধারাবাহিকতায় এখন আছি জিটিভিতে।
কাদের জন্য এই পেশা উপযোগী?
আমার মতে যারা সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত তাদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত পেশা। অথবা যাদের সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ আছে তাদেরই এই পেশায় আসা উচিত, তা না হলে এই পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। আর এর প্রমাণ কিন্তু আমরা পাচ্ছি।
কীভাবে করেন এই কাজ?
আসলে আমরা যে যেই প্রতিষ্ঠানেই থাকি না কেন, আমাদের চাওয়াটা কিন্তু এক। আর তা হলো আমাদের চ্যানেলের নিউজ যাতে দৈনিক পত্রিকাগুলো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। আর এই জন্য শুধু সংবাদ প্রেরণ করে বসে থাকলে হয় না। কেননা এখন চ্যানেল সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে একপ্রকার অসুবিধায় পড়তে হয় বিনোদন সাংবাদিকদের। টেলিভিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তাদের তাই দায়িত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। প্রতিটি সংবাদ প্রেরণ করে বিনোদন প্রধানদের ফোনে জ্বালাতন করাও গণসংযোগ কর্মকর্তাদের কাজের একটি অংশ। আবার চ্যানেলের নিজস্ব কোনো ইভেন্ট কিংবা প্রেস কনফারেন্সেও একজন পিআরের ভূমিকা অনেক। ওই ইভেন্ট ও কনফারেন্সকে সর্বস্তরের মানুষের দৌড় গোড়ায় পৌঁছানোর মূল কাজটাই পড়ে একজন পিআরের উপর।
গুলশান হাবিব রাজীব
পাবলিক রিলেশনে আমাদের দেশে ক্যারিয়ার কেমন বলে আপনি মনে করেন?
আমি চার বছর ধরে পাবলিক রিলেশন বিভাগে কাজ করছি। চার বছর আগে এই সেক্টরে কাজের গুরুত্ব কম ছিল। মূলত বহুজাতিক কোম্পানিতে পাবলিক রিলেশন বিভাগ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হতো। বর্তমানে যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় প্রতিটি কোম্পানিতে এই বিভাগ গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে পাবলিক রিলেশন অফিসার পদে অনার্স ও মাস্টার্স পাস চাওয়া হচ্ছে। টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসেও এই পদে লোকবল নিয়োগ হচ্ছে।
পাবলিক রিলেশনে টেলিভিশন ও অন্যান্য কোম্পানিতে কি পার্থক্য আছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রতিষ্ঠানভেদে পাবলিক রিলেশন বিভাগের কাজে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে পাবলিক রিলেশন বিভাগে কাজ করছি, তাই আমার মনে হয় সাংবাদিকতায় ধারণা থাকলে পাবলিক রিলেশন বিভাগে বেশ ভালোভাবে কাজ করা যায়। অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় টেলিভিশনে এই বিষয়টা বেশ কাজে আসে। একটা নিউজকে পত্রিকা ও পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় করা সহজ হয়। অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রে নিউজটা তেমন গুরুত্ব বহন করে না। আর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ টেলিভিশন কিংবা অন্যান্য কোম্পানি উভয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
পাবলিক রিলেশনে কাজ করতে একজনের কেমন প্রস্তুতি থাকা দরকার?
পড়ালেখার সাথে সাথে স্মার্টনেস থাকা আবশ্যক। একজনের সাথে ভালোভাবে কথা বলা, কারও সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যাক্তিত্ববোধ থাকা জরুরি।
একটি কোম্পানির ক্ষেত্রে পাবলিক রিলেশন বিভাগের গুরুত্ব কেমন?
একটি কোম্পানির প্রচারের ক্ষেত্রে পাবলিক রিলেশন বিভাগের গুরুত্ব অনেক। কোম্পানির অনেক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পাবলিক রিলেশন বিভাগ। বিভিন্ন কোম্পানিতে বিশেষ করে প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল পাবলিক রিলেশন বিভাগকে কার্যকর করে তোলার চেষ্টা করছে। কয়েকটি চ্যানেল একাধিক পাবলিক রিলেশন অফিসার নিয়োগ করছেন, যেন তাদের কাজ আরও গতিশীল হয়।
হাশিম রনি
পাবলিক রিলেশন্স অফিসার এর কাজ কী?
পাবলিক রিলেশন্স অফিসারের মূল কাজ হলো প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং করা, জনগনকে প্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন উপায় এবং উপকরণের ব্যবহার করা। তবে টেলিভিশন মিডিয়ায় দায়িত্বরত পাবলিক রিলেশন্স অফিসারের অন্যতম প্রধান কাজ হলো চ্যানেলে প্রচারিত অথবা নতুন অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্রিকার বিনোদন পাতায় প্রচারের মাধ্যমে ওই অনুষ্ঠানের দর্শকপ্রিয়তা বৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। বিশেষ অনুষ্ঠানমালার প্রচারের জন্য প্রয়োজনে টিভি গাইড বের করা, শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বিলবোর্ড স্থাপন, নিজের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইভেন্ট ও প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের জড়ো করা, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদান করা প্রভৃতি।
পাবলিক রিলেশন্স অফিসার হতে একাডেমীক যোগ্যতা প্রয়োজনীয়তা বলুন।
পাবলিক রিলেশন্স অফিসারের কাজের সাথে এক সাংবাদিকের কাজের যথেষ্ট মিল রয়েছে। একজন সাংবাদিকের মতোই পাবলিক রিলেশন্স অফিসারকেও প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হয়। পত্রিকার বিনোদন পাতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের চমত্কার উপস্থাপন এর কাজটি পাবলিক রিলেশন্স অফিসারই করে থাকেন। কাজেই সাংবাদিকতা ও গণসংযোগের ছাত্ররাই এই পদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান পছন্দ। তবে অন্যান্য যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করেও যদি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা, প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিংয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, তাহলে তিনিও পাবলিক রিলেশন্স অফিসার হতে পারেন।
এই পেশার স্বাধীনতা কতটুকু?
আসলে এই পেশাটা আমি বলব প্রায় পুরোটাই স্বাধীন। নিজের অফিসের কাছেও গুরুত্ব বাড়ে দিনকে দিন। কাজে গতি থাকলে এবং দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে সখ্যতা থাকলে কাজটা খুবই সহজ হয়। আর নিয়মিত কাজ করলে সখ্যতাটা এমনিতেই হয়ে যায়। সেদিক থেকে এর বাইরেও অনেক কাজ করা যায়। যেমন আমি এর বাইরে নাটক পরিচালনা ও লিখে থাকি।Source: http://goo.gl/wGp6WW