ওডেস্কের আউটসোর্সিং খাতে শীর্ষ তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ
শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরির অপেক্ষায় দিন গুনছেন এমন তরুণদের সংখ্যা যখন বেড়েই চলছে, বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক রফতানির ফলে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার যখন আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে বাংলাদেশের রিজার্ভ মানিতেও যখন টান পড়েছে, ঠিক সে সময়ে আন্তর্জাতিক আউট সোর্সিংয়ে বাজার জিতে নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশের তরুণ আউট সোর্সাররা। ভারতের মতো বাংলাদেশেরও সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে এই ক্ষেত্রটির মাধ্যমে। এক দিকে বিদ্যুৎ সংকট, সরকারের সময়োপযোগী নীতিনির্ধারণ ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের স্বেচ্ছা বাণিজ্যে ধীরগতির ইন্টারনেট সেবা, তার পরও, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ঘরে বসে বিশ্বব্যাপী কাজের বাজারে কাজ দাতাদের টেন্ডারে অংশ নিচ্ছে আমাদের সোনার ছেলেরা। তারা সারাবিশ্বের আউট সোর্সারদের সঙ্গে পালা দিয়ে কাজ বাগিয়ে এনে পৃথিবীর সব দেশের আউট সোর্সারদের মধ্যে এখন শীর্ষ তিনে রয়েছে।
এ তথ্য জানা গেল ইন্টারনেট দুনিয়ায় কাজ কেনাবেচা করা অন্যতম মার্কেটপ্লেস ওডেস্কের সহ-সভাপতি ম্যাট কুপারের মুখ থেকেই। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে আউট সোর্সারদের অ্যাপ্রিসিয়েশন অনুষ্ঠান শেষে দেশ ত্যাগ করার প্রাক্কালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও একটি অভাবনীয় তথ্য জানান। তা হল, বাংলাদেশের আউট সোর্সাররা সারা পৃথিবীর আউট সোর্সারদের থেকে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিগত তিন বছরের অভিজ্ঞতায়।
ওডেস্কের সহ-সভাপতি ম্যাট কুপারআউট সোর্সিং নিয়ে এ সময়ে ব্যাপক আলোচনা থাকায় ম্যাট কুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল আউট সোর্সিংয়ে যারা কাজ করছেন এবং আগামীতে যারা এই পেশায় আসবেন তাদের জন্য।
ওডেস্ক ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ক র্যাংকিংয়ে ৩ বছরে শীর্ষ ৩ মার্কেটপ্লেসগুলোর একটি। ৪৫ ভাগ কাজের বাজার ওডেস্কের দখলে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আউট সোর্সিংয়ে বাংলাদেশ জব রেন্টারদের কাছে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। (এই সারিতে অবশ্য ভারত ও ফিলিপাইন রয়েছে।)
এদেশের উৎসাহী তরুণরা ওডেস্কের তালিকায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে। ওডেস্কের পক্ষ থেকে তাদের জন্য সশরীরে সনদ বয়ে এনেছি। আমি মনে করি এই সম্মাননায় বাংলাদেশের তরুণরা আরও উৎসাহিত হবে ও নতুন উদ্যমে কাজ করবে।
এ দেশের ৭০ ভাগ প্রজন্মই তারুণ। আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি তারা আইসিটি খাতে দারুণ এগিয়েছে। তাই জনসংখ্যা এদেশের জন্য সমস্যা নয়। বরং সম্পদ। তবে সুদক্ষ আর পেশাভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের জন্য সরকারকে প্রণোদনা প্যাকেজের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
আরও ভালো করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছ?বাংলাদেশের আউট সোর্সারদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি। তাদের কাজের জন্য যা অবশ্যই প্রয়োজন। বিকল্প পদ্ধতিতে এই সমস্যার সমাধান অনেক ব্যয়বহুল। তাই এ অবস্থার সুরাহা না হলে আউট সোর্সিং সম্ভাবনায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
এ ছাড়াও ইন্টারনেট গতি নিয়েও অনেক সমস্যার কথা জেনেছি আউট সোর্সারদের সঙ্গে কথা বলে। ভালো হবে বাংলাদেশ যদি ইউনিভার্সাল ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড সেবাকে বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। বিশ্বের অন্য সব দেশে আউট সোর্সিংয়ে এই ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার হয়।
ম্যাট কুপারএ ছাড়াও আপনি বিদেশে কাজ করলেন, কিন্তু সেই ডলার বাংলাদেশী টাকায় কনভার্ট করতে এখন প্রতিটি আউট সোর্সারদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে পেপ্যাল চালু হওয়া একান্ত জরুরি। এটা আউট সোর্সারদের প্রাণের দাবি। এটা সত্যিই একটি বড় বাধা। এ নিয়ে ওডেস্ক সরকারের সঙ্গে 'ডায়লগ ওপেন' করেছে। অচিরেই গ্লোবাল ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ওডেস্ক তাদের পেমেন্ট পদ্ধতি চালু করার চেষ্টা করছে। এটি সম্ভব হলে বাংলাদেশে আউট সোর্সিংয়ে তাদের সবচেয়ে বড় বাধাটি অতিক্রম করবে। তখন আরও বেশি তরুণ এ খাতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশকে কেন তোমরা এত গুরুত্ব দিচ্ছ?দেখ, আমরা হলাম মার্কেট প্লেস, এখানে কেউ কাজ দিবে আবার কেউ কাজ করবে। বাংলাদেশকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এ সময়ে পুরো বিশ্বেই আউট সোর্সিং নির্ভরতা বাড়ছে। স্থির অফিসের তুলনায় এখন মোবাইল অফিস জনপ্রিয় হচ্ছে। আর বাংলাদেশে এ কাজের জন্য চমৎকার পরিবেশ আছে। কেননা বাইরেরটা অস্থির হলেও সমস্যা নেই, ঘরে বসেই তুমি কাজ করতে পারছ। এমন কী গ্রামে বসেই তুমি পৃথিবী চষে কাজ খুঁজে আনতে পারছ।
এ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা আয় করার সুযোগ রয়েছে তোমাদের। এই অংক দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সবকিছু ঠিকমতো এগোলে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী ওডেস্কের জন্য কাজ করছেন। আর আয়ও করছেন তুলনামূলক অনেক ভালো। গড়ে তোমাদের প্রতিটি কর্মী ঘরে সবেই ৬/৭ হাজার টাকার মতো মাসিক আয় করছ। বাংলাদেশ গত ৩ বছরে আউট সোর্সিংয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে তুলে ধরেছে। বিশ্বের কোন দেশই এখন আউট সোর্সিংয়ে বাংলাদেশকে খাটো করে দেখে না। বরং বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আউট সোর্সিং কনট্রাক্টররা ঘণ্টায় ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ ডলার আয় করে। আর বাংলাদেশে কনট্রাক্টররা ঘণ্টায় ন্যূনতম ৫ থেকে ১০ ডলার আয় করার মাধ্যমেই সন্তুষ্ট থাকে, যা একটি মার্কেটপ্লেসে বাংলাদেশকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলেছে। এখানে উন্নত বিশ্বের আউট সোর্সারদের পিছে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
কোন কোন ধরনের কাজ কারা করবেনএ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন এবং অ্যানড্রয়েড অ্যাপস ও আইওএস'র ব্যাপক চাহিদা। বাংলাদেশের আউট সোর্সাররা আরও একটু দক্ষ হয়ে উঠলে আউট সোর্সিং র্যাংকে বাংলাদেশ আরও উচ্চতায় চলে আসবে।
তখন ঘণ্টা ভিত্তিক আয় ১০ ডলার থেকে বেড়ে ১০০ ডলারে পৌঁছতে পারবে। এখনই বাংলাদেশের অনেক আউট সোর্সারের এই দক্ষতা রয়েছে।
এ ছাড়াও ওয়েব রিসার্চ, ওয়েবসাইটে পিআর (পাবলিক রিলেশন), ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, রাইটিং অ্যান্ড ট্র্যানসলেশন, কাস্টমার সার্ভিস, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সাপোর্ট, নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া এবং বিজনেস সার্ভিসেস এ কয়েকটি বিভাগে আউট সোর্সিং কাজের সুযোগ রয়েছে।
তবে 'সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন' খাতে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো করছে। এই কাজটি সহজেই করা যায় বলে তোমাদের তরুণ প্রজন্ম বেশি আকৃষ্ট হয়েছে এই কাজে।
ভালো করতে হলে যা প্রয়োজনকম্পিউটার সায়েন্সের তুলনায় অভিজ্ঞতা এবং সৃষ্টিশীলতা যাদের আছে আউট সোর্সিংয়ে তারাই ভালো করবেন।
সব মিলিয়ে নিজের যোগ্যতা আর দক্ষতার সঙ্গে নিয়মিত ইংরেজি চর্চা করলে আউট সোর্সিং হয়ে উঠতে পারে চাকরির বিকল্প কর্মসংস্থান। সঠিক সময়ে কাজ দিতে পারলেই আয়ের পথটা আরও সুনিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশে ওডেস্কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাবাংলাদেশের তরুণদের পাশে সব সময়ই ওডেস্ক আছে এবং থাকবে। তবে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ওডেস্ক আউট সোর্সিংয়ের ওপর বিশেষ ইন্সটিটিউট করার পরিকল্পনা আছে। সেটা হলে বাংলাদেশে অবশ্যই আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। তবে অল্প দিনের মধ্যে আবারও বাংলাদেশ সফরে আসছি।
সম্ভাব্য সংকটআমরা দেখেছি একটানা দীর্ঘ সময় ইন্টারনেটে কাজ করার কারণে স্বাস্থ্যগত কিছু ঝুঁকি রয়েছে আউট সোর্সারদের। আজ হয়তো তারা অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করবে, কিন্তু বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকলে যে ঝুঁকি রয়েছে, বা তরুণরা ছাত্রাবস্থায় পর্যাপ্ত ডলার আয়ের মাধ্যমে যে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে উঠতে পারে এ বিষয়ে তোমাদের কোন
সতর্কতামূলক কার্যক্রম আছে?হ্যাঁ, স্বাস্থ্যগত একটা ঝুঁকির বিষয় আছে। তবে সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কেননা প্রতিদিন তুমি সামান্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারো, আবার পারিবারিক গেট টুগেদারে নিয়মিত অংশ নিয়ে সামাজিক সংকটেরও মোকাবেলা করতে পার। তবে কোনভাবেই নিয়মিত শিক্ষার বাইরে গিয়ে আউট সোর্সিংয়ে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা অবশ্য ওডেস্ক অফিসে কিছু স্পোর্টস আইটেম ব্যবহার করি, নিয়মিত আমাদের পরিবারগুলোর অংশগ্রহণে গেট টুগেদার করি।
যদিও এ বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম আমাদের নেই। তবে প্রত্যেকের স্বাস্থ্যগত দিকটা তাদের নিজেদেরই ঠিক রাখতে হবে। সম্ভব হলে আমরাও এ বিষয়ে পরিকল্পনা নেব।
সংগৃহীত