স্যাটেলাইট এর ধরন
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট (নং-১) মূলত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫,৮৫৩ কিলোমিটার দূরে থাকবে। এটাকে জিওস্টেশনারি অরবিট (বাংলায় ভূস্থির কক্ষপথ) বলা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ হল যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট। ৩.৭ টন বা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির ডিজাইন এবং তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস। আর যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্স তাদের ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে ফ্লোরিডার লঞ্চপ্যাড থেকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে।
অবস্থান
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথে। এর ফুটপ্রিন্ট বা কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। শক্তিশালী কেইউ ও সি ব্র্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কাভার করবে পুরো বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া। দূর থেকে টর্চের আলো যেমন একটা আলোকিত বৃত্ত তৈরি করে, তেমনি স্যাটেলাইটের রেডিও সিগন্যাল শুধু একটা এলাকা থেকে পাওয়া যায়। সেই এলাকাটাকে সেই স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট বলা হয়। স্যাটেলাইট বসার সেই জায়গাগুলোকে অরবিটাল স্লট (কক্ষঘর) এবং International Telecommunication Union (ITU) প্রতিটি দেশকে আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে স্লট দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ১৫ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ১১৯.১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাতে একটা স্লট লিজ নিয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে ফুটপ্রিন্ট পড়বে।
মেয়াদকাল
১৫ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে অরবিটাল স্লট কেনা হয়েছে। তবে স্যাটেলাইটটির স্থায়িত্ব হতে পারে ১৮ বছর পর্যন্ত। স্যাটেলাইট এমনিতেই এক জায়গায় থাকে না, আস্তে আস্তে সরতে থাকে। সেটাকে মাঝে মাঝে আবার ঠিক জায়গায় নিয়ে আসতে হয়। যখন মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, কিছু না করলে স্যাটেলাইট এমনিতেই নিচে নামতে নামতে একসময় বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে এবং পুড়ে যাবে। পরবর্তী স্যাটেলাইট একই স্লট নিতে পারে অপেক্ষা না করেই। ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের মতোই স্যাটেলাইটের ক্যাপাসিটি দিন দিন বাড়ছে আর দাম কমছে। ৫০ বছর টিকবে এমন স্যাটেলাইট বানানো সম্ভব, কিন্তু সেটি ১০-১৫ বছর পরে আর নতুন স্যাটেলাইটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। স্থায়িত্বের কথা মাথায় রেখে এভাবেই তৈরি করা হয়। আর লাইসেন্সও ১৫ বছরের জন্যই দেয়া হয়ে থাকে। যেন শেষদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ কর্মক্ষম থাকে স্যটেলাইটটি।
স্যাটেলাইট অপারেশন
আর্থ স্টেশন থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্যাটেলাইটটির কক্ষপথে যেতে সময় লাগবে ৮-১১ দিন। এরপর প্রথম ৩ বছর থ্যালাস অ্যালেনিয়ার সহায়তায় এটির দেখভাল করবে বাংলাদেশ। পরে পুরোপুরি বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের হাতেই গাজীপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া আর্থ স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে এটি।
উৎক্ষেপণ
উৎক্ষেপণের পর প্রায় ৩৩ মিনিটে এটি নির্ধারিত কক্ষপথে পৌঁছায়। উৎক্ষেপণের পর নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে রকেটের স্টেজ-১ খুলে যায়। এরপর স্টেজ-২ কাজ শুরু করে। আবার ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ এরপর সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং অবতরণ করে আটলান্টিকে ভাসমান ড্রোন শিপে।
অর্থায়ন
কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনার জন্য ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একনেক সভায় দুই হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশ। এছাড়া 'বিডার্স ফাইন্যান্সিং' এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হংকং সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (এইচএসবিসি) সঙ্গে সরকারের প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি হয়। এক দশমিক ৫১ শতাংশ হার সুদসহ ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে এ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার সংস্থা ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে অরবিটাল স্লট অনুমোদন দেয়া হয়। এর অর্থমূল্য ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাজ
টিভি চ্যানেলগুলোর স্যাটেলাইট সেবা নিশ্চিত করাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রধান কাজ। এর সাহায্যে চালু করা যাবে ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস। এছাড়া যেসব জায়গায় অপটিক ক্যাবল বা সাবমেরিন কেবল পৌঁছায়নি, সেসব জায়গায় এ স্যাটেলাইটের সাহায্যে নিশ্চিত হতে পারে ইন্টারনেট সংযোগ। এবং মূল কাজ হল টিভি সম্প্রচার, ভিস্যাট ও ডিটিএইচ।
সুবিধা
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে ৩ ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে। টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্যাটেলাইট ভাড়া করে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট চ্যানেলের সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সি ক্ষমতা হল ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। এর ব্যান্ডউইডথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেটবঞ্চিত অঞ্চল যেমন পার্বত্য ও হাওর এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া সম্ভব। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবা, টেলিমেডিসিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারেও ব্যবহার করা যাবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়ে। তখন এর মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে। এর বাইরে এ থেকে অন্য কোনো সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা অমূলক। তার বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যারা কল্পকথা ছড়ানোর চেষ্টা করেন, সেটা অবশ্যই দূরভিসন্ধিমূলক।
অন্যান্য কৃত্রিম উপগ্রহ
কৃত্রিম সম্প্রচার ও যোগাযোগ উপগ্রহের বাইরেও নানাবিধ স্যাটেলাইট রয়েছে, যা মহাশূন্য দর্শন (স্পেস অবজারভেশন, এস্ট্রনমি), বিশেষ বিশেষ গবেষণা, বিশেষায়িত টেলিযোগাযোগ, নেভিগেশন, সার্চ অ্যান্ড রেস্কিউ, আবহাওয়া পরিমাপ (ওয়েদার অ্যান্ড এটমোস্ফেরিক স্টাডি), রিমোট সেন্সিং ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এজন্য ওই বিশেষ কৃত্রিম উপগ্রহকে বিশেষ বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়ে থাকে। যোগাযোগ স্যাটেলাইটে যেমন থাকে ট্রান্সপন্ডার, তেমনি আবহাওয়া উপগ্রহগুলোয় পে লোড হিসাবে থাকে রেডিও মিটার (রেডিয়েশন মাপার যন্ত্র), স্কেটারোমিটার (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাস, যেমন : কার্বন ডাই-অক্সাইড, ওজন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি পরিমাপক), লাইটিং ইমেজার (বিদ্যুৎ চমকানো মনিটর করা) ইত্যাদি। এছাড়া গবেষণা কাজে নিয়োজিত উপগ্রহে স্পেকট্রেমিটার (তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ স্ট্যাডি মনিটর করা), আলটিমিটার (উচ্চতা ও স্পেস ডিসট্যান্স মাপা) ইত্যাদি নামক বিভিন্ন ধরনের মনিটরিং যন্ত্র ও ক্যামেরা থাকে।
যেহেতু বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে শুধু ট্রান্সপন্ডার নামক যন্ত্র আছে এবং এর বাইরে ওপরে বর্ণিত অন্য কোনো যন্ত্র বা ক্যামেরা নেই, তাই এটা মূলত ডিজিটাল টিভি ব্রডকাস্টিং, রেডিও ব্রডকাস্টিং এবং একটি যোগাযোগ স্যাটেলাইট। আশা করি, এই পর্যায়ে এসে বিভ্রান্তির কিছুটা অবসান হবে এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-কে জড়িয়ে অতি উৎসাহীদের প্রত্যাশাগুলো যেহেতু অবিবেচনাপ্রসূত এবং অযৌক্তিক, সে কারণে এটিকে নিয়ে অতি উৎসাহীদের কল্পকথা ছড়ানো কমে আসবে।
Source: https://www.jugantor.com/todays-paper/it-world/50123/%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81-%E0%A7%A7-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%93-%E0%A6%85%E0%A6%AF%E0%A7%8C%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AF%E0%A6%A4-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A6%BE