বাংলাদেশের মোট জাতীয় রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে পোশাকশিল্প থেকে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহমুদ হাসান আরিফ ও সাবিহা সুলতানা বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে বিপুল সংখ্যক মার্চেন্ডাইজার কাজ করেন। বায়ার অর্থাৎ বিদেশি ক্রেতাদের প্রথমে কয়েকটি পোশাকের স্যাম্পল দেখাতে হয়। বায়ারের কোনো একটি স্যাম্পল পছন্দ হলে এর প্রাইস অফার করেন মার্চেন্ডাইজার। প্রাইস অ্যাকসেপ্ট হলে চাহিদা অনুযায়ী কাপড় ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি সরবরাহ করা এবং বায়ারদের অনুমোদন সাপেক্ষে তা যথাসময়ে জাহাজিকরণ করাই একজন মার্চেন্ডাইজারের কাজ। বলছিলেন টেক্স ভেলির মার্চেন্ডাইজার আবু কায়েস। এ সম্পর্কে একই প্রতিষ্ঠানের নাসিম আহমেদ জানান, শুধু এক্সপোর্টই নয়, অনেক সময় পোশাক তৈরিতে যত রকম কাপড় ও এক্সেসরিজ দরকার হয়, তা ইমপোর্টও করতে হয় মার্চেন্ডাইজারকে। যেমন- বাটন, জিপার, সুতা, লেবেল, টুইল টেপ, পলি, কার্টন, গাম টেপ ইত্যাদি। দরদাম করে এলসির মাধ্যমে বিদেশ থেকে কেনার দায়িত্ব থাকে মার্চেন্ডাইজারের ওপর। যোগ্যতা 'যেকোনো বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীরা এ পেশায় আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইংরেজিতে পারদর্শিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলতে হবে এবং প্রোডাক্ট সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা দিতে হবে। একই সঙ্গে কম্পিউটার জানাটাও আবশ্যক। কারণ বায়ারদের সঙ্গে ই-মেইলেই যোগাযোগটা করতে হয়, কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে আপডেট দিতে হয়'- বলছিলেন, বায়িং হাউস টেক্সট ইউরোপের মার্চেন্ডাইজার ইমতিয়াজ নাসিম। কাজের ক্ষেত্র বর্তমানে বাংলাদেশে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত বায়িং হাউসের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। বিজিবিএর সদস্যভুক্ত বায়িং হাউসের সংখ্যা দুই শত। এ দুই সংগঠন ছাড়াও আলাদাভাবে কাজ করছে আরো ৬০০ থেকে ৮০০ বায়িং হাউস। সব মিলিয়ে বায়িং হাউসের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। প্রতিটি বায়িং হাউসে গড়ে চারজন করে মার্চেন্ডাইজার কাজ করে। আর বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। এখানেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে চার থেকে আটজন মার্চেন্ডাইজার কাজ করেন। বলছিলেন নাসিম আহমেদ। প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বায়িং হাউস ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে দক্ষ মার্চেন্ডাইজারের সংখ্যা। তাই পেশা হিসেবে মার্চেন্ডাইজিংকে বেছে নিতে হলে প্রস্তুতি নিতে হবে ভালোভাবে। পদোন্নতি এ পেশায় শুরুতে অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার হিসেবে নিয়োগ হয়। এরপর যোগ্যতা অনুযায়ী মার্চেন্ডাইজার, সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার এবং মার্চেন্ডাইজার ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি হয়। বায়ারদের সঙ্গে কথা বলে কে কত সহজে কাজটি আদায় করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করে পদোন্নতি। বলছিলেন সায়ান জিনসের মার্চেন্ডাইজার এহতেশামুল হক। মেয়েদের কাজের ক্ষেত্র এ সেক্টরে দিন দিন মেয়েদের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় পাওয়া যাচ্ছে না দক্ষ মেয়ে মার্চেন্ডাইজার। ক্ষেত্রভেদে ছেলেদের তুলনায় এ সেক্টরে মেয়েদের সফলতার হার বেশি। তবে ৯টা-৫টা অফিসের বাইরে বেশিক্ষণ কাজ করতে হয় বলে মার্চেন্ডাইজিং বিভাগের কমার্শিয়াল অফিসার হিসেবে বেশির ভাগ মেয়ে কাজ করছেন। বলছিলেন টেক্স ভেলি গ্রুপের মার্চেন্ডাইজার কাম অ্যাসিস্ট্যান্ট কমার্শিয়াল অফিসার আতিয়া আকতার নীপা। মেয়ে কমার্শিয়াল অফিসাররা মূলত আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিংয়ের কাজগুলো করেন। বেতন-কাঠামো মার্চেন্ডাইজিং পেশায় শুরুতে বেতন হিসেবে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা হতে পারে। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া ফ্রেশার হিসেবে শুরু করলে বেতন আট হাজার টাকা থেকে শুরু হতে পারে। চার থেকে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মার্চেন্ডাইজারের বেতন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। জানান কেআরসি কম্পোজিটের মার্চেন্ডাইজার সাজ্জাদ হোসেন। প্রশিক্ষণ নেবেন কোথায় মার্চেন্ডাইজার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি ছয় মাস থেকে এক বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ফলে একজন ফ্রেশারের তুলনায় শুরুতেই বেতন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি হয়ে থাকে। দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ডাইজিংয়ের ওপর কোর্স করিয়ে থাকে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হলো- বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিআইএফটি) এখানে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে খরচ পড়বে ৯২ হাজার টাকা, দুই বছর মেয়াদি এমবিএ কোর্স এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ দুটি কোর্সের জন্য প্রার্থীর যোগ্যতা প্রয়োজন ন্যুনতম গ্রাজুয়েশন। তবে চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সে এইচএসসি পাস হলেই চলবে। এই কোর্সে খরচ পড়বে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। চারটি কোর্সেই বছরে দুটি সেশনে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো হয়। সেশন দুটি হচ্ছে জানুয়ারি ও জুন। ঠিকানা-এসএ টাওয়ার, ১০৫, উত্তরা কমার্শিয়াল এরিয়া, সেক্টর-৭, ঢাকা। ফোন : ৮৯১৯৯৮৬। মার্চেন্ডাইজারস ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি (এমআইএফটি) এখানে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সের খরচ পড়বে ৪০ হাজার টাকা, ৬ মাস মেয়াদি এক্সিকিউটিভ কোর্সের খরচ পড়বে ১৫ হাজার টাকা এবং চার মাস মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্সে খরচ পড়বে ১০ হাজার টাকা। ঠিকানা- বাড়ি-৬৬, এয়ারপোর্ট রোড, আমতলী মহাখালী। ফোন : ৮৮১২১৯৭, ০১৭১৬৬৭২৬৬৩। পিনাকল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি (পিআইএফটি) এ প্রতিষ্ঠানে চার মাসব্যাপী অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং কোর্সে খরচ পড়বে ৯ হাজার ৫০০ টাকা। ছয় মাসব্যাপী ডিপ্লোমা ইন অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং কোর্সে খরচ পড়বে ১৮ হাজার টাকা। এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং কোর্সে খরচ পড়বে ৩৫ হাজার টাকা। সবগুলো কোর্সে নূ্যনতম ভর্তি যোগ্যতা গ্রাজুয়েশন। ঠিকানা- ২৪৪, নিউ সার্কুলার রোড, মালিবাগ, ঢাকা। ফোন : ৯৩৫২৬৫৬, ০১৯৭৭৩৩৭৭৪৪। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি (এনআইএফটি) ছয় মাসব্যাপী অ্যাডভান্স সার্টিফিকেট কোর্র্সে খরচ পড়বে ৩৫ হাজার টাকা, দুই বছর মেয়াদি এমবিএ কোর্সে এক লাখ ৩৬ হাজার টাকা, এক বছরব্যাপী ডিপ্লোমা কোর্স ৬৫ হাজার টাকা। সবকটি কোর্সের জন্যই নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা গ্রাজুয়েশন। ঠিকানা- বীর উত্তম জিয়াউর রহমান সড়ক, আমতলী মহাখালী, ঢাকা। ফোন : ৮৮৩১৩০৫, ০১৭১৩১১৬৩১৩। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন ডিজাইন (আইআইএফডি) ছয় মাসব্যাপী সার্টিফিকেট কোর্সে খরচ পড়বে ৩২ হাজার টাকা। সার্টিফিকেট কোর্সের জন্য নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা গ্রাজুয়েশন হতে হবে। ঠিকানা- ৪১, কামাল আতার্তুক এভিনিউ (লেকের কাছে), বনানী, ঢাকা। ফোন : ৯৮৬২৩৪১, ০১৯১২১৩০৮৬২। আইইউবিএটি এখানে মার্চেন্ডাইজিংয়ের ওপর তিন মাস মেয়াদি একটি কোর্স করানো হয়। এতে খরচ পড়বে ১৫ হাজার টাকা। শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে গ্রাজুয়েট হতে হবে। ঠিকানা- ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস, সেক্টর-১০, উত্তরা, ঢাকা। ফোন : ০১৭১৫১৩৩০০৮। সাক্ষাৎকার অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কোর্স করায় না এহতেশামুল হক মার্চেন্ডাইজার, সায়ান জিনস লিমিটেড ২০০৫ সালে আমি স্কাই ওয়ার্ল্ড নামের একটি বায়িং হাউসে অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার হিসেবে জয়েন করি। শুরুতে বেতন ছিল আট হাজার টাকা। এক বছরের মাথায় মার্চেন্ডাইজার হিসেবে পদোন্নতি পাই। তিন বছর মার্চেন্ডাইজার হিসেবে একটানা কাজ করে গত বছর সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার হয়েছি। এখন আমার বেতন ৪৫ হাজার টাকা। কিছুদিনের মধ্যে নিজেই একটি বায়িং হাউস দেওয়ার কথা ভাবছি। এখানে নতুনদের কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে এর জন্য দক্ষ হয়ে এ সেক্টরে আসাই ভালো। দক্ষতা অর্জনের জন্য ভালো কোনো ইনস্টিটিউট থেকে মার্চেন্ডাইজিংয়ের ওপর কোর্স করতে পারেন। তবে আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠানই মার্চেন্ডাইজিং কোর্স করানোর কথা বলে, আদতে স্টুডেন্টদের কাজে লাগে এমন কিছুই শেখাচ্ছে না তারা। তাই আগেভাগে খোঁজ নিয়ে ভর্তি হলে ভালো হয়। আর কোর্স করতে না পারলে ভালো মার্চেন্ডাইজারের সহযোগী হিসেবে এক বছর কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বায়িং হাউসগুলোতে খোঁজ নিয়ে এক বছর কম বেতনে ইন্টার্নি করতে পারেন। শুরুতে বেতন কম হলেও অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেতনও বাড়তে থাকে। দক্ষতা ও স্মার্টনেট দুটোই গুরুত্বপূর্ণ গোলাম মাওলা পরিচালক, মার্চেন্ডাইজারস ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি আসলে এ সেক্টরে কাজ শিখে দক্ষতা অর্জন করে তবেই আসা উচিত। আর স্মার্টনেস এ পেশার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঠিকমতো বায়ারদের ট্যাকেল করাও জানতে হবে। আমাদের এখানে একটি কাপড়ের সুতা থেকে পোশাক বায়ারের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত যা যা দরকার, তার সব কিছু সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বায়ারদের সঙ্গে কিভাবে ডিল করতে হয়, অর্ডার কিভাবে নিতে হয়, বায়ারদের সঙ্গে ই-মেইলে কিভাবে যোগাযোগ করতে হয়, এলসি কিভাবে খুলতে হয়, পোশাক সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীদের বুকিং এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, বায়ারস অ্যাপ্রোভাল এবং তাদের চাহিদামতো পোশাক সঠিক সময়ে জাহাজিকরণ এবং চালান বায়ারের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সবগুলো প্রক্রিয়া শেখানো হয়।
Source: http://infopedia.com.bd/career/job-search-strategy/1489