আপনি যখন চাকরিদাতা
যে প্রার্থী সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে না চেয়ে বেতন, ছুটি, কর্মদিবস, কর্মঘণ্টা ইত্যাদি সম্পর্কে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন তাঁর সম্পর্কে সচেতন হোন
সৈয়দ আখতারুজ্জামান
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
ব্রিজ ইনস্টিটিউট অব ট্রেনিং
অ্যান্ড কনসালট্যান্সি(http://www.kalerkantho.com/assets/images/news_images/print/2013/12/30/14_36052.jpg)
সঠিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে সমস্যার অন্ত নেই। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের খালি পদ আছে, উপযুক্ত মূল্য দিতেও তারা প্রস্তুত; কিন্তু যোগ্য প্রার্থী নেই। এমন অনেক যোগ্য প্রার্থী আছেন, যাঁরা খালি উপযুক্ত পদ খুঁজে পাচ্ছেন না। আপনি প্রতিষ্ঠানের মালিক বা চাকরিজীবী যা-ই হোন না কেন, আপনি নিয়োগকর্তা হিসেবে মহাসংকটেই থাকেন সব সময়। এই সমূহ শাঁখের করাতের ভেতরেও যথাসাধ্য সাফল্যের মুখ নিশ্চিত করতে দশ পরামর্শ-
এক.
একটি জীবনবৃত্তান্ত হাতে নেওয়ার আগে ভেবে দেখুন, একটি সঠিক নিয়োগ যেমন একটি প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি একটি ভুল নিয়োগ কোনো কর্মকর্তার ক্যারিয়ার তছনছ করে দিতে পারে। ভেবে দেখুন, নিয়োগকর্তা হিসেবে আপনার যাচাই-যোগ্যতা যথেষ্ট কি না। একটি সঠিক নিয়োগের বেশির ভাগ কৃতিত্ব যেমন আপনার, তেমনি একটি ভুল নিয়োগের বেশির ভাগ দায়ভারও আপনার। কারণ চাকরি নিশ্চিত করতে নিয়োগকর্তার সিদ্ধান্তই প্রধান, প্রার্থীর ভূমিকা সামান্যই। নিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্তটি আপনাকেই নিতে হবে।
দুই.
প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্তে যা যা লেখা আছে, তার কতটা আক্ষরিক আর কতটা আলংকারিক দেখে নিন। শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রতি বেশি নজর দিন।
তিন.
প্রার্থী অভিজ্ঞ হলে পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে তার রেকর্ড যাচাই করুন। প্রার্থী ফ্রেশ হলে আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যাচাই করুন অথবা বিভাগীয় বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। যেমন- প্রার্থী যদি হিসাবরক্ষণ বিভাগের পদপ্রার্থী হয়, তাহলে হিসাবরক্ষণ বিভাগের একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিন। পেশাদার নিয়োগকর্তা অবশ্য একজন বিশেষজ্ঞের মতামতেই নিশ্চিত হন না। যতজন হলে সঠিক নিয়োগ নিশ্চিত হবে, প্রয়োজনে ততজনকেই একত্র করেন তিনি। মূলত বিষয়টি পরিস্থিতি বুঝে নির্ধারিত হয়।
চার.
সাধারণ নিয়োগ হলে তিন ধাপে যাচাই করুন। ক. জীবনবৃত্তান্ত যাচাই ও প্রাথমিক সাক্ষাৎকার, খ. লিখিত/বুদ্ধিমত্তা/মনস্তাত্তি্বক পরীক্ষা এবং গ. চূড়ান্ত সাক্ষাৎকার ও নিয়োগ। উচ্চপদে নিয়োগ হলে এই সনাতন পদ্ধতি বিবেচ্য নয়। তখন নিয়োগ বোর্ড গঠন করুন। ওই পদের জন্য প্রার্থীকে যাচাই করতে যাঁরা সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে মনে করেন, তাঁদের সাহায্য নিন।
পাঁচ.
যদি ফ্রেশ প্রার্থীদের অধিক সংখ্যায় নিয়োগ দিতে হয় (যেমন- সুপারশপ, বাজারজাতকরণ বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান), তাহলে প্রি-সার্ভিস ট্রেনিং পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এতে নিয়োগ সঠিক হওয়ার হার যেমন বাড়ে, তেমনি রিটেনশনের (কর্মী ধরে রাখার) হারও বেড়ে যায়। এ পদ্ধতিতে প্রার্থীকে নিয়োগের আগে এক সপ্তাহ থেকে দু্ই সপ্তাহ পর্যন্ত একটি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যেখানে প্রার্থীকে তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য, প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রীতিনীতি- নানা বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। দীর্ঘ সময়ে নানা রকম প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় প্রার্থীকে। শেষে চূড়ান্ত সাক্ষাৎকারে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় একজন প্রার্থী যেমন প্রতিষ্ঠানকে বুঝে নেওয়ার সময় পান, প্রতিষ্ঠানও প্রার্থীকে ভালোভাবে যাচাইয়ের সুযোগ পায়।
ছয়.
প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্তে উলি্লখিত রেফারেন্সের সঙ্গে কথা বলুন। জীবনবৃত্তান্তে লিখিত তথ্য যাচাই করুন এবং যা লেখা নেই, কিন্তু আপনার জানা জরুরি এমন বিষয়গুলোও জেনে নিন। যেমন- প্রার্থীর চরিত্র, সততা, অন্য মানবিক গুণাবলি, আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত পদ হলে আরো বিস্তারিত কথা বলুন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে তথ্য যাচাই করতে গিয়ে কোনোভাবেই প্রার্থীর সম্মানহানি না হয়, তা প্রার্থী যত অধস্তন পদের জন্যই আবেদন করুন না কেন।
সাত.
প্রার্থীকে প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস রুল সম্পর্কে অবহিত করুন। নিয়োগের সময় সার্ভিস রুল অ্যাগ্রিমেন্টের ওপর প্রার্থীর সম্মতি প্রদানমূলক স্বাক্ষর নিন (সার্ভিস রুল অ্যাগ্রিমেন্টে প্রতিষ্ঠানে সব নিয়মনীতির কথা পরিষ্কার লিখিত থাকে)।
আট.
যে প্রার্থী সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে না চেয়ে বেতন, ছুটি, কর্মদিবস, কর্মঘণ্টা ইত্যাদি সম্পর্কে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাঁর সম্পর্কে সচেতন হোন। মনোভাব অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনোভাবজনিত সমস্যার কারণে অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীই ফলাফলশূন্য। মাস শেষেও পূর্ণমাত্রায় বেতন পাওয়াকে চাকরির স্বর্ণ-শিখর বলে মনে করেন। প্রতিষ্ঠানকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়োগের সময়ই এ ধরনের 'জীবাণু' শনাক্ত করতে হবে।
নয়.
এমন অনেক সময় আসে, যখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও যোগ্য প্রার্থী বাদ দিয়ে অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগ দিতে হয়, আবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অযোগ্য প্রার্থীকে বরখাস্ত করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ দিন, তবে মূল পদে নয়। প্রতিষ্ঠানে বাফার স্টাফ বা সাবস্টিটিউট স্টাফ বা অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে রাখার একটি প্রচলিত পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে হঠাৎ মানবসম্পদের ঘাটতি হলে বা চাহিদা বেড়ে গেলে বাফার স্টাফ পরিস্থিতি সামাল দেয়। নিশ্চিত করুন, এদের উপস্থিতি যেন মূল কাজে বড় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠানের উন্নতি নিশ্চিত করতে যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে বহাল রাখা নিয়োগকর্তা হিসেবে আপনার প্রধান কর্তব্য।
দশ.
আত্মীয়স্বজন, সমবয়সী বন্ধু, স্নেহভাজন বা শ্রদ্ধাভাজন কাউকে নিজ প্রতিষ্ঠানে শুধু সম্পর্কের কারণে চাকরি দেবেন না। নিয়োগের ক্ষেত্রে সবার ওপরে যোগ্যতার স্থান দিন। আপনার আবেগময় অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের ক্ষতি থেকে প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করুন।
akhter.bst@gmail.comSource: http://goo.gl/syo5Aa