সামগ্রিক উন্নয়নে গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা
বিজ্ঞানের প্রতিনিয়ত আবিষ্কার মানবজাতিকে সব সময় নতুন পথ দেখায়। বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এবং নতুন নতুন তথ্য প্রদান করছে মানবসভ্যতাকে, যা মানবকল্যাণে অপরিহার্য। বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণা মানবকল্যাণের জন্য প্রথম এবং প্রধান পথÑ এ কথা আজ সবার কাছে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে যে জাতিগুলো আজ উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পেরেছে, তারা সবাই বিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং গবেষণার জন্য প্রচুর বরাদ্দ দিয়েছে তাদের দেশের বার্ষিক মোট বাজেটের বিপুল একটা অংশ। বর্তমান বিশ্বে গবেষণা ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। সিঙ্গাপুরের মহান নেতা এবং আধুনিক উন্নত সিঙ্গাপুরের প্রণেতা লি কুন ইউ বলেছেন, আমেরিকা আরও অনেকদিন বিশ্বে রাজত্ব করবে, কারণ তারা প্রতিবছর গবেষণার জন্য যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয় তা উন্নত বিশ্বের কোনো দেশ দেয় না, তাদের সেই সক্ষমতা নেই। আমাদের দেশকেও উন্নত গবেষণার দ্বারা অতিদ্রুত উন্নত দেশে পরিণত করা সম্ভব, তাই বর্তমান সরকার আগের তুলনায় গবেষণায় অনেক বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে এবং গবেষণার ক্ষেত্রে অর্থ আজ কোনো সমস্যা নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানীর সহধর্মিণী ছিলেন, তিনি বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব জানেন। তাই তিনি বারবার বলেছেন, গবেষণায় আজ অর্থ কোনো সমস্যা নয়। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমকে, তিনি এই দেশেই পাটের জিনোম আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি জাতি সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম। বিজ্ঞান গবেষণায় যে এ দেশের সন্তানরা পিছিয়ে নেই, তার প্রমাণ সোনালি আঁশের (পাট) জীবনরহস্য উন্মোচন এবং 'ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা' নামক ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন।
এই ছত্রাক পাটসহ ৫০০টি উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাধা দেয়। প্রয়াত বিশ্ববিখ্যাত জিনবিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের মতো হাজার হাজার বিজ্ঞানী এ দেশেই জন্ম হওয়া সম্ভব, শুধু প্রয়োজন তাদের একটু অনুপ্রাণিত করা এবং কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান সরকার অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজ্ঞান গবেষণার কোনো বিকল্প নেই এবং প্রযুক্তিনির্ভর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও এই বিজ্ঞান গবেষণাই হবে প্রধান হাতিয়ার।
আমরা আজ স্বপ্ন দেখছি ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচিত করানোর এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করা; এসব কিছুই সম্ভব তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং যুগোপযোগী বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে। আজ দেশ শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রসঙ্গক্রমে এখানে দেশের বিখ্যাত গবেষক, শিক্ষক ও লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের গবেষণাসংক্রান্ত দুটি কথা বলতে চাই। তিনি বলেন, 'সুযোগ পেলেই আমি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে বলি পৃথিবীতে যত রকমের আনন্দ আছে তার মাঝে সবচেয়ে সেরা আনন্দ হচ্ছে গবেষণার আনন্দ। একজন বিজ্ঞানী যখন গবেষণা করে পৃথিবীতে এক টুকরো নতুন জ্ঞান নিয়ে আসেন, যে 'জ্ঞান'টুকু আগে পৃথিবীতে ছিল নাÑ এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হতে পারে না। গবেষণার সেই আনন্দটুকু পেতে পারেন শুধু একজন বিজ্ঞানী কিংবা গবেষক, আর কেউ কোনোদিন সেটি অনুভব করতে পারেন না। তাই আমি নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানী হতে উৎসাহ দিই। একজন ছেলে বা মেয়ে বড় হয়ে যদি বিজ্ঞানী হন তাহলে শুধু তিনি নিজের জীবনটা উপভোগ করতে পারবেন তা নয়, তিনি আসলে দেশেরও সেবা করতে পারবেন। নতুন পৃথিবী গড়ে উঠেছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি দিয়ে, আমরা যদি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে চাই তাহলে আমাদের দরকার বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদ। এই দেশে যত বেশি বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদ জন্ম নেবে, দেশটি তত তাড়াতাড়ি পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।' তাই বুঝতেই পারছেন, দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কী পরিমাণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, আজও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানী বা গবেষকদের সামাজিক মূল্যায়নটা বুঝতে পারেননি, সে কারণেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের সেরা ছাত্ররা পড়াশোনা শেষ করে স্বপ্ন দেখেন বিসিএস দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে চাকরি নেওয়ার; এর পেছনের কারণটা হলো, দেশে গবেষক বা বিজ্ঞানীদের মর্যাদাটা এখনো সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এই জায়গাটায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সমাজে বিজ্ঞানীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে; তা না হলে এই পেশায় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আসবেন না। দুঃখের বিষয় হলো, অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে এই পেশায় এলেও অন্যান্য ক্যাডার চাকরির সুযোগ-সুবিধার কারণে তারা এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান। আজ এ কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে, দেশের খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এই দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের ভূমিকা অপরিসীম, তাদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন ভ্যারাইটি কৃষকরা অতিদ্রুত গ্রহণ করেছেন এবং তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। মৎস্যবিজ্ঞানীদের কারণে দেশের মানুষ আজ দুবেলা মাছ খেতে পারছেন, দেশীয় অধিকাংশ মাছ আজ বিলুপ্তপ্রায়, নদ-নদী দূষণ আর ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের কারণে এমনটি হয়েছে।
অন্যদিকে পোলট্রিশিল্পে আজ আমরা অনেকটা এগিয়ে, আজ যদি বয়লার মুরগি আর ডিম না থাকত তা হলে দেশের ষোলো কোটি মানুষকে আর ডিম খেতে হতো না। দেশে প্রচুর সবজি উৎপাদন হচ্ছে এবং বিদেশে পর্যন্ত রপ্তানি হচ্ছে, এর সবকিছুর মূলে হলো গবেষকদের ভূমিকা, তাহলে বুঝুন এই ক্ষেত্রটিকে আমাদের কতটা গুরুত্ব দিতে হবে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা গবেষক হিসেবে অনেক ভালো গবেষণা করছেন, এমনকি নাসায়ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী রয়েছেন। আজ আমরা গ্লোবাল ভিলেজের কথা বলছি, এটাকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবী থেকে মেধাবী স্টুডেন্টকে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া তাদের দেশে আশ্রয় দিচ্ছে এবং অনুন্নত দেশের মেধাবী গবেষকরা সেখানে পিএইচডি কিংবা পোস্ট ডক্টরেট করতে গিয়ে সেখানেই থেকে যাচ্ছেন। আমাদের দেশ থেকে যেসব গবেষক ওইসব দেশে গিয়ে অধিকাংশই আর ফিরে আসছেন না, এটা খুবই হতাশাজনক। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা, তারা যেন দেশের গবেষকদের কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটান, তা না হলে সাধারণ মানুষও এই পেশাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন না। আমরা যদি আজ উন্নত বিশ্বের দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাব তারা তাদের জিডিপির অনেক বড় একটা অংশ গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যয় করে, যেটাকে তারা এক ধরনের বিনিয়োগ মনে করে। কারণ একটা গবেষণায় অর্থ ব্যয় করলে সেটা যদি সফলতা পায় তবে ব্যয়িত অর্থের কয়েকশ গুণ খুব দ্রুত ফিরে আসে। যুক্তরাজ্যের রয়াল সোসাইটির উপাত্ত অনুসারে ২০১১ সালে বিভিন্ন দেশ কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে তাদের গবেষণা ক্ষেত্রে (আরএন্ডডি) মোট জিডিপির অংশ হিসেবে তার একটা চিত্র তুলে ধরা হলো। ইথিওপিয়া ১০ কোটি মার্কিন ডলার (০.১৭%), ভিয়েতনাম ৫০ কোটি মার্কিন ডলার (০.১৯%), মালয়েশিয়া ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার (০.৬৩%), পাকিস্তান ৩৬৭ কোটি মার্কিন ডলার (০.৬৭%), সিঙ্গাপুর ৬৩০ কোটি মার্কিন ডলার (২.২%), তুরস্ক ৬৯০ কোটি মার্কিন ডলার (০.৭%), ভারত ৩৬১০ কোটি মার্কিন ডলার (০.৯%), দক্ষিণ কোরিয়া ৫৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার (৩.৭%), চীন ২৯৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার (১.৯৭%) এবং যুক্তরাষ্ট্র ৪০৫৩০ কোটি মার্কিন ডলার (২.৭%) খরচ করে।
সেই তুলনায় দেশের বার্ষিক গবেষণা খাতে মোট জিডিপি থেকে বরাদ্দ খুবই নগণ্য, তবে বর্তমান সরকার এ বরাদ্দের ক্ষেত্রে খুব সচেতন এবং খরচ করতে রাজি আছে। শুধু আমাদের গবেষকদের প্রয়োজন এগিয়ে এসে নতুন নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আইডিয়াগুলো সরকারের সামনে তুলে ধরা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, গবেষণা হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চতুর্থ চাকা; তিনটি চাকা দিয়ে যেমন গাড়ি চলবে না (অন্য চাকাগুলো যতই মজবুত হোক না কেন), চতুর্থ চাকার প্রয়োজন রয়েছে। ঠিক তেমনি আমাদের গবেষণা খাতকে উন্নত করতে না পারলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। আমাদের দেশে আর একটি সমস্যা হলো, গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো বেসরকারি কোম্পানি (এন্টারপ্রেনারশিপ) এগিয়ে আসছে না অনুদানের ক্ষেত্রে। উন্নত বিশ্বে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা বিভিন্ন কোম্পানির ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে সেই কোম্পানির সমস্যাগুলো সমাধান করে থাকেন এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন, যে প্রযুক্তিগুলোর প্রেটেন্ট রাইট ওই কোম্পানির হয় এবং সরকার সেখানে সহযোগিতা করে। আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর সেই সক্ষমতা রয়েছে, তারা যদি এগিয়ে আসে তবে অতিদ্রুত এই ক্ষেত্রটি উন্নতি লাভ করবে।
উন্নত এবং অতিদ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের মোট জিডিপির প্রায় ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করে, এর দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, একবিংশ শতাব্দীর সমাজ ও জীবনের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই আর দ্বিতীয়টি হলো গবেষণার বিনিয়োগের সুফল শত শত এমনকি কয়েক হাজারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করবে এবং সমাজে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। এতে করে আমাদের সমাজের অনেক দুর্নীতি কমে যাবে এবং সমাজে সামাজিক নিরাপত্তা বিরাজ করবে। কারণ হিসেবে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি, কোনো মানুষ ইচ্ছে করে দুর্নীতি করতে চায় না, সমাজে সব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকলে মানুষ কাজ করে নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চায়। আর সমাজ ও রাষ্ট্র ভালো থাকলে আমরা সবাই ভালো থাকব।
https://goo.gl/kWg06e